১।
আপনার বয়স হয়েছে অনেক। এক জীবনে অনেক কিছু দেখেছেন, শিখেছেন।
ইদানিং খাবারের খুব অভাব। গ্রামে দুর্ভিক্ষ চলছে। যুবকরাই খাবার পায় না, বুড়োদের কে দেখবে? তার উপর কিছুদিন আগে রাস্তায় হাটতে যেয়ে এক্সিডেন্ট হয়েছে, বাম পাটা অচল হয়ে গিয়েছে।
ছোটবেলায় অনেক স্বপ্ন ছিল, ডাক্তার হবেন, জাকারবার্গ আর বিল গেটসের দেখাদেখি ভার্সিটি ড্রপআউট হতে গিয়ে এখন হয়েছেন ঝালমুড়িওয়ালা।
সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করা দরকার।
তাই, আপনি ফিরে গেলেন আপনার গুহায়। সেখানে রাখা আছে অ্যান্টি এইজিং মেশিন, আপনি ঢুকলেন সেখানে যেয়ে। মেশিনে শুয়ে থাকলে আস্তে আস্তে আপনার বয়স কমবে। আপনি বৃদ্ধ থেকে যুবক হবেন, তারপর কিশোর, শেষ পর্যন্ত একেবারে শিশু। তারপর বের হয়ে এসে পুরোটা জীবন নতুন করে শুরু করতে পারবেন।
এই কাজ আপনি পারবেন। কারন আপনি মানুষ না। সমুদ্রের অমর জেলিফিশ Turritopsis dohrnii.
জেলিফিশদের জীবন এমনিতেই চরম উদ্ভট। ডিম ফুটে স্বাভাবিকভাবে অন্য প্রাণীদের মতো জেলিফিশের জন্ম হয় না। জন্ম হয় ছোট, চ্যাপ্টা অণুজীবের মতো একটা প্ল্যানুলা লার্ভা। ওই লার্ভা কিছুদিন খায় দায় ঘুরে বেড়ায়, তারপর একসময় শক্ত কোন কিছুর সাথে মতো লেগে যায়। ওইখান থেকে জন্মায় হাইড্রার মতো অদ্ভুত একটা জীব, নাম তার পলিপ। দেখতে গাছের মতো, ডালপালা আছে, এক জায়গায় লেগে থাকে, হাঁটাহাঁটি করে না। আবার কোষগুলো প্রাণী কোষ , নড়াচড়া করে, শিকার ধরে খায়।
গাছ বড় হলে কি হয়? ফুল ধরে, রাইট? পলিপ বড় হলে ওইখান থেকে ফুলের মত মেডুসা বের হয়। একটা গাছ, তাতে অনেকগুলো ফুল। একটা পলিপ থেকে অনেক মেডুসা। পলিপ গাছের ফুল, ওই মেডুসাগুলোই হলো আমাদের পরিচিত গোল গোল, থলথলে জেলিফিশ। গ্রিক দানব মেডুসার মাথা ভর্তি সাপ ছিল, আর তার চোখের দিকে তাকালে মানুষ পাথর হয়ে যেত। জেলিফিশদের চোখ নেই, কিন্তু তার সুন্দর থলথলে শরীরটার চারপাশ দিয়ে বেরইয়ে এসেছে সাপের মত অসংখ্য টেন্ট্যাকেল। প্রতিটা মারাত্মক বিষাক্ত, ধরলে সাপের মতোই ছোবল দিবে।
একসময় মেডুসা বড় হবে। ছেলে মেডুসা মেয়ে মেডুসা বিয়ে করবে। ডিম পারবে। ডিম থেকে জন্ম হবে নতুন লার্ভার। সেখান থেকে জন্ম হবে নতুন পলিপ গাছের। তারপর বয়স হলে মেডুসা মারা যাবে। যদি না ...
যদি না সে অমর জেলিফিশ টুরিটপ্সিস হয়। সে মরবে না। খাবারের অভাব দেখলে সে হাত পা গুটিয়ে ছোট হয়ে ফিরে যাবে শিশুকালের পলিপ অবস্থায়। ঠিক যেন প্রজাপতি আবার ফিরে গেল তার শুঁয়োপোকা দশায়। মুরগি ছোট হয়ে ডিম হয়ে গেল।
তারপর সেখান থেকে আবার জন্ম হলো নতুন মুরগির, নতুন জেলিফিশের।
এই খানে একটা ক্যাচ আছে। ফুল ছোট হয়ে যদি গাছ হয়ে যায়, ওই গাছ থেকে তো অনেকগুলো ফুল ফুটবে, একটা না। কোন ফুলটা আসল ফুল?
২।
এটা একটা দুঃস্বপ্নের গল্প।
দস্তয়ভস্কি অনেক বড় ভুল করেছে। ড্রাগ লর্ড আলবার্ট যখন ছেলেটার বুকে ছুড়ি চালিয়েছিল আড়াল থেকে সব দেখে ফেলেছে সে।
তাকে আর বাঁচতে দেওয়া যায় না।
দস্তয়ভস্কিকে নিয়ে আসা হয়েছে জনমানবশূন্য জঙ্গলে। পাঁচজন মানুষ পাঁচ দিক থেকে চেপে ধরে তাকে হত্যা করল। তারপর লাশটা পাঁচ টুকরা করে, পাঁচটা বস্তায় ভরে পুতে ফেলল মাটিতে।
মৃত্যুর সময় তার কষ্ট হয়েছিল খুব, মুখ বাঁধা ছিল তাই চিৎকারও করতে পারে নি।
করলে সে জোর গলায় জানিয়ে দিত, আমি আবার আসব।
কিছুদিন পরের কথা।
দস্তয়ভস্কির কাটা লাশ বড় হলো গর্তে।
ডান পা টায় জন্ম হলো নতুন পেট বুক মাথা আর বাম পা।
বাম পা পেলো একই রকম নতুন আরেকটা দেহ।
কাটা মাথাটার নতুন হাত পা বুক পেট গজালো, সেও হলো আরেকটা মানুষ।
দস্তয়ভস্কি ফিরে এল পাঁচ কপি হয়ে। এই কাজ তার দ্বারা সম্ভব হয়েছে, কারন সেও মানুষ না। সে হচ্ছে অমর ফ্ল্যাট ওয়ার্ম প্ল্যানেরিয়ান।
প্ল্যানেরিয়ান হলো নিরীহ চেহারার একটা চ্যাপ্টা ক্রিমি। ক্রিমি হলেও সে বেশ স্বাধীনচেতা, নদী সমুদ্রে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়, পেটের ভিতর বন্দি জীবন তার পছন্দ নয়। এরা বুড়ো হয় না। জরা মৃত্যু এদের স্পর্শ করে না। এদেরকে কুচি কুচি করে কাটলে প্রতিটা টুকরা বাকি অঙ্গগুলো তৈরি করে নেয়। মাথা কেটে ফেলে দিলে কাটা মাথাটায় জন্ম হয় নতুন পেট আর লেজ, লেজে জন্ম হয় নতুন মাথা।
মানুষের বয়স বাড়ার অন্যতম হলো প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় DNA র শেষ অংশ টেলমিয়ারের একটা অংশ হারিয়ে যায়। হারাতে হারাতে যখন DNA খুব ছোট হয়ে যায় ওই কোষ আর বিভাজিত হতে পারে না। টেলোমারেজ এনজাইম টেলমিয়ারের ওই ভাঙ্গা অংশ ঠিক করে দেয়। মানুষের জীবনের একেবারে প্রথম প্রজায়ে টেলমারেজ অনেক পরিমাণে থাকে, পরে আস্তে আস্তে কমে যায়। যে হারে কোষ মরে সেই হারে কোষের জন্ম হয় না। মানুষ তাই আস্তে আস্তে বুড়িয়ে যায়।
প্ল্যানেরিয়ান সেরকম না। তার টেলোমারেজের কোনদিন কমতি হয় না। তাই তার মাথা কেটে ফেললেও নতুন করে মাথার জন্ম হয়।
৩।
ভবিষ্যতে মানুষ কি অমর হবে? জেলিফিশদের মতো বুড়ো থেকে শিশু হতে পারবে? অথবা প্ল্যানেরিয়ানদের মতো বার্ধক্যকে পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারবে? উল্ভারিনের মতো হাত কাটলে কি নতুন হাত গজাবে? মাথা কাটলে মাথা?
মানুষ অনেক জটিল প্রাণী প্ল্যানেরিয়ানের তুলনায়। তার পরও, গবেষণা চলছে। দেখা যাক।
৪।
এই যে অমর প্রাণীরা, এরা কি হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকে? আসলেই মরে না?
না। এরা মরে অন্য প্রাণীর শিকার হয়ে।
ভবিষ্যতে সত্যি যদি মানুষ অমর হয়, আর একের পর এক বাচ্চা দিতে থাকে, তাদের মৃত্যু কিভাবে ঘটানো হবে ভাবলে ভয় লাগে।
৫।
মাথা কেটে ফেলার পর যে নতুন মাথাটা জন্মায় সেটাতে তো আগের কোন স্মৃতি থাকার কথা না, সে তো একেবারে নতুন মানুষ, সরি প্ল্যানেরিয়ান রাইট?
নাহ, নতুন মাথাটা আগের স্মৃতি মনে রাখে।
কিভাবে, কেউ ঠিক জানে না।
গবেষণা চলছে।
৬।
গভীর সমুদ্রের আশ্চর্য জগতে আর একবার স্বাগতম!
সৌজন্যেঃ Nayeem Hossain Faruque
Follow Us