
১।
তাবুতে রাত কাটিয়েছেন কখনো?
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল রেমা কালেঙ্গার জঙ্গলে আর পাবলাখালির জঙ্গলে ২টা রাত তাবুতে কাটানোর। অসাধারন অভিজ্ঞতা। তাবুতে ঢুকতে হয় লাইট নিভিয়ে, নাহলে রাজ্যের পোকামাকড় তাবুর ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। রাত ১০ টা ১১টার পর মানুষের সব কোলাহল বন্ধ হয়ে যায়। জঙ্গল মুখর হয় ঝি ঝি পোকা , মশা মাছি আর আর নাম না জানা অসংখ্য পশু পাখির শব্দে। রেমা কালেঙ্গার জঙ্গলে তাবুতে শুয়ে শুকরের ঘোঁত ঘোঁত শুনেছি, একবার কি জানি একটা ছোট প্রাণী তাবুর বাইরে আমার পা ছুয়ে চলে গেছে, এই এক্সপেরিয়েন্স যে জঙ্গলে রাত কাটায় নি তাকে বোঝান যাবে না।
রেমা কালেঙ্গা থেকে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি আমাজনের জঙ্গলে। ধরলাম, বেশ বড়সড়, শক্তপোক্ত একটা তাবুতে রাত কাটাচ্ছেন। জাগুয়ার ঢুকতে পারে না এমন শক্ত। রাত ২টার দিকে, প্রাকৃতিক কাজ করার জন্য বাইরে যাবেন, টর্চ জানলেন। শুরু হোল আতংকের।
তাবুর দরজার উপর দাড়িয়ে, ৮টা চোখ মেলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে প্রায় ১ ফুট চওড়া, সাড়া গা লোমে ঢাকা Goliath Bird Eating Spider.
গুড লাক, রন!

২।
গোলিয়াথ বার্ড ইটিং ট্যারান্টুলা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাকড়শাগুলর ১টা। প্রায় ১১ ইঞ্চি চওরা এর রোমশ শরীরটার ওজন ১৭৫ গ্রামের মত। যদিও পাখি এর নরমাল খাবারের মধ্যে পড়ে না, মাঝে মাঝে শখ করে ১টা ২টা পাখি ধরে খায়, তাই এর নাম হয়েছে বার্ড ইটিং ট্যারান্টুলা। পোকামাকড়দের মধ্যে সবচেয়ে বড় হোল অ্যাটলাস মথ আর কুইন আলেকজান্দ্রিয়ার বার্ড উইং প্রজাপতি। এরা ২ জনই প্রায় ১ ফুট চওড়া। খুব বেশি না, তারপরও একফুট চওড়া একটা প্রজাপতি ঘরে উড়াউড়ি করলে আমার খুব একটা শান্তি লাগবে না। পিপড়ার রেকর্ড ২ ইঞ্চি, বাট বিলিভ মি ওই ২ ইঞ্চি লম্বা পিঁপড়ার সামনে আপনি পড়তে চাইবেন না। আর মধ্য আমেরিকার ৪ ইঞ্চি লম্বা জায়ান্ট তেলাপোকা আমার বাথরুমে উড়াউড়ি করুক আমি কক্ষনো সেটা চাইবো না।
আমাদের খুব ভাগ্য ভাল ৩ ৪ ফুট লম্বা একটা মাকড়সা আমাদের দেওয়ালে বসে থাকে না, ৭-৮ ফুটের চ্যারা বাথরুমে কিলবিল করে না, একফুট লম্বা তেলাপোকা উড়াউড়ি করে না। কেন পোকামাকড় বড় হয় না? সবসময় কি এরা ছোট ছিল?
মিট কারবনিফেরাস।
৩।
পোকামাকড় মাকড়শা এরা নিঃশ্বাস নেয় ট্রাকিয়ার সাহায্যে, কোন লাংস নাই এদের। চামড়ার ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে বাতাস শরীরে ঢুকে, তারপর সেটা বাতাসের চাপে শরীরে ছড়িয়ে যায়। পোকা যত বড় হয়, অক্সিজেনের চাহিদা মেটানোর জন্য তার ট্রাকিয়াগুলো আরও বেশি বেশি করে মোটা হয়। একটা সাইজের পর এত বেশি ট্রাকিয়া হয়ে যাবে যে ট্রাকিয়াকে জায়গা দিতে হলে হৃদপিণ্ড, পাকস্থলি, ব্রেইন এগুলোকে একটা একটা করে বাইরে ফেলা লাগবে। পোকা তাই ছোটই থাকে, বেশি বড় হয় না।
এখন বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ২১% এর মত, থ্যাংকস টু এয়ার পলিউশান, এই অক্সিজেনও কার্বন ডাই অক্সাইডের জন্য জায়গা করে দিচ্ছে। অনেক অনেকদিন আগে, প্রায় ৩০ কোটি বছর আগে এমনটা ছিল না। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল ৩৩% এর মত। পোকাদের জন্য রীতিমত স্বর্গরাজ্য।
চলুন ঘুরে আসি কারবনিফেরাসের দুনিয়া থেকে।

৪।
প্রায় ৩৬ থেকে ২৯ কোটি বছর আগের সময়কালকে পৃথিবীর ইতিহাসে কারবনিফেরাস পিরিয়ড বলা হয়। এটা অনেক অনেকদিন আগের কথা। মাত্র চার হাজার বছর আগে কোন একটা দ্বিপে পৃথিবীর শেষ ম্যামথটা বেচে ছিল। ডাইনোসর টি রেক্সের শেষ হুঙ্কারটি শোনা যায় সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে। আর হাটি হাটি পা পা করে প্রথম, ছোট ছোট আদিম ডাইনোসররা পৃথিবীতে আসে ২২ কোটি বছর আগে। তারও ৭ - ৮ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে চলছিল কারবনিফেরাস।
সেই সময় পৃথিবীতে একটা গাছেরও ফুল ছিল না, ফল ছিল না। কোথাও কোন পাখি ছিল না, ম্যামাল ছিল না। মাছেরা প্রথম মাটিতে উঠে এসে উভচর হয়ে তখন পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে যুগে সাড়া পৃথিবীতে ছিল বিশাল বড় বড় রেইন ফরেস্ট। সোয়াম্প ফরেস্ট বললে আরও ভালো হয়। কারবনিফেরাসের ফার্ন গাছগুলো মাটির নিচে যেয়ে, ফসিল হয়ে, শেষে কয়লায় পরিণত হয়ে আজকে সাড়া পৃথিবীর কয়লার চাহিদা মেটাচ্ছে। তাই এই সময়কালকে বলা হয় কারবনিফেরাস পিরিয়ড।
সেই ঘন, দুর্ভেদ্য, কর্দমাক্ত সোয়াম্প ফরেস্টে রাজত্ব করত পোকামাকড়রা। আপনি দিনশেষ খুব খাটাখাটনি করে আপনার নৌকায় ঘুমানোর আয়োজন করছেন? আপনাকে হতে হবে খুব সাবধান। ৮ ফুট লম্বা চ্যারা আর্থোপ্লুরা ঘুরাঘুরি করছে আশেপাশে, নৌকায় উঠতে পারলে খবর আছে। একেকটার সাইজ কুমিরের সমান, তাই সাবধান।
সন্ধ্যার দিকে একেবারে ছইয়ের ভিতর ঢুকে থাকলে ভালো হয়। এই সময় ফড়িং উড়াউড়ি করে। ফড়িং কে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে ? মেগানিউরা নামের কারবনিফেরাসের এই ফড়িং এখন পর্যন্ত পাওয়া পোকামাকড়দের মধ্যে সবচেয়ে বড়, এদের উইংস্প্যান আড়াই ফুট। প্রায় ঈগল সাইজের একেকটা ফড়িং তার বিশাল ২টা মৌচাকের মত পুঞ্জাক্ষি মেলে শিকার খুঁজছে জলাভূমিতে, বন্দুকটাকে হাতের কাছে রাখতে ভুলবেন না।
মাটিতে নেমে কোন একটা ট্রি ফার্নে চরে রাত কাটাবেন? আরও খারাপ কথা, ৩০ ইঞ্চি লম্বা বিছা ঘুরে বেড়াচ্ছে, এদের স্টিং মারাত্মক।
সব দিক ঠিক করার পর ঘুমাতে গেলে ১ ঘণ্টা আগে অ্যালার্ম দিয়ে রাখবেন, দিনরাত কিন্তু এখন সাড়ে ২২ ঘণ্টা, আর সকাল হলেই ফড়িঙের উড়াউড়ি শুরু হয়ে যাবে।
আজকে আসি। অন্য কোনোদিন হয়তো আপনাদের ঘুরিয়ে আনবো অন্য কোন যুগ থেকে।
সৌজন্যেঃ Nayeem Hossain Faruque
Follow Us