#solarcell #physics #quantumchemistry #সৌরবিদ্যুত #পদার্থবিজ্ঞান 


লেখাটি একটু বেশি লম্বা, কিছুটা বরিং। হয়ত সবার জন্য নয় কারণ কিছু পক্রিয়া বিজ্ঞানভিত্তিক শব্দ দিয়েই লেখা হয়েছে, তবে কমেন্টে কেউ জানতে চাইলে একটু সহজ ভাবে বলার চেষ্টা করব। লেখালেখি করার অভ্যাস না থাক্য এমনটি হয়ছে। ইচ্ছে আছে এর পরের ধাপ নিয়ে লেখার। 

 -----------------------------------------------------

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায়, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। ২০১৫ সালে পৃথিবীর সব দেশেরে নেতারা প্যারিসে মিলিত হয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলেসিয়ের নিচে রাখার ঐক্যমত্যে পৌছায়। এই গ্রীন হাউস গ্যাস, CO2 সবচেয়ে বেশি পরিমাণ উৎপন্ন হয় জ্বীবাস্ব জ্বালানি ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করতে গিয়ে। এটি রোধ করার একমাত্র বিকল্প হচ্ছে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার। আর এই নবায়নযোগ্য শক্তির সবচেয়ে বড় উৎসটি হচ্ছে সুর্য। 


সূর্যের শক্তিকে আমরা ভিবিন্ন ভাবে ব্যাবহার করতে পারি, কিন্তু তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক এবং ব্যাবহার উপযোগী হচ্ছে বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তর। যে বিদ্যুৎ কোষ সৌর শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তর করে থাকে সৌরকোষ বা সোলার সেল বা ফটোভল্টাইক সেল বলে। সূর্য রশ্নি থেকে যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় সে পদ্ধতিকে বলা হয় ফটোভোল্টাইক ইফেক্ট। ১৮৩৯ সালে এডমন্ড ব্যাকের‍্যাল সর্বপ্রথম এটি আবিস্কার করেন। এর প্রায় ৩৫ বছর পর- ওইলিগবি স্মিথ ১৮৭৩ সালে আবিস্কার করেন সেলেনিয়াম ধাতুর উপর সুর্যালোক পড়লে কোন তাপ অথবা চলমান যন্ত্র ছাড়াই বিদ্যুৎ উপন্ন করতে পারে যদিও তা ছিল খুবই কম সময়ের জন্য। ১৮৮৩ সালে চার্লস ফ্রিটস সেলেনিয়াম ধাতুর উপর সোনার প্রলেফ দিয়ে একটি সোলার সেল তৈরী করতে সমর্থ হন, যার কর্মদক্ষতা ছিল ২% চেয়েও কম। এরপর অনেকগুলো যন্ত্রই সোলার সেল হিসাবে প্যাটেন্ট হয়, কিন্তু এর সবই ছিল সূর্যালোক থেকে তাপ শক্তি, তাপ শক্তি থেকে  বিদ্যুৎ তৈরীর যন্ত্র, যাকে বলা হয় সোলার থার্মাল প্রযুক্তি। প্রথম ফটোভোল্টাইক সেল প্যাটেন্ট করেন রাসেল অহ্ল ১৯৪১ সালে। সেটি ছিল সিলিকন সেমিকন্ডাক্টর ভিত্তিক যন্ত্র। এর পর থেকে সিলিকন এবং জার্মেনিয়ামই মুলত সোলার সেল তৈরীতে ব্যাবহার হয়ে আসছে। আমেরিকার বেল ল্যাবরেটরি প্রথম ব্যাবহার উপযোগী সোলার সেল তৈরী করেন, যা মুলত মহাকাশ প্রযুক্তি এবং উচ্চমানের প্রযুক্তিতে ব্যাবহার করা হত। বানিজ্যিক ভাবে প্রথম সোলার সেল তৈরী হয় ১৯৫৬ সালে, ওয়েষ্টার্ন ইলেক্ট্রিক, যদিও উচ্চ মুল্যের কারণে বাজারে তেমন বেশি চলেনি। 

সুর্যলোক থেকে বিদ্যুৎ কিভাবে উৎপন্ন হয়? অথবা মাত্র কয়েকটি বিশেষ ধাতু বা যৌগ কেন এইভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে? এটির উত্তর নিহীত আছে কোন মৌল বা যৌগের ইলেক্ট্রনিক গঠনের মধ্যে। আমরা জানি সব ধরণের মৌলকে মুলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়, ধাতু, উপধাতু এবং অধাতু। কোন একটি মৌলের সর্ববহিস্থ কক্ষপথের একটি ইলেকট্রন কত সহজে প্রথম অপূর্ন কক্ষপথে নেওয়া যায় সেটার উপর ভিত্তি করে এই শ্রেনী বিভাগ। কোন বস্তুর উপর যখন আলোকরশ্নি পড়ে, ইলেকট্রন সেই আলো শোষন করে শক্তিপ্রাপ্ত হয়, যার ফলে সেটি উচ্চ শক্তিস্তরে গমন করে। ধাতুর ক্ষেত্রে বহিস্থস্থরের ইলেকট্রনটি অনেকটা মুক্ত অবস্থায় থাকে, যেটিকে একটি পরমাণুর না বলে সম্পুর্ন ধাতব খন্ডটির ইলেকট্রন বলা যায়, কারণ এটির উপর নিউক্লিয়াসের আকর্ষন অনেক বেশি কম হওয়ায় অনেকটা স্বাধীন ভাবেই ঘুরাফেরা করতে পারে। অপরদিকে অধাতুর ক্ষেত্রে বহিস্তস্থর আর প্রথম অপুর্ন স্তরের শক্তির পার্থক্য অনেক বেশি হওয়ায়, ইলেকট্রনকে উত্তেজিত করে অপুর্ন স্তরে নিয়ে যেতে অনেক বেশি শক্তির দরকার হয়। উপধাতু হচ্ছে সবচেয়ে মজার। এদের ইলেকট্রন ধাতুর মত সম্পুর্ন মুক্ত অবস্থায়ও থাকে না, আবার উত্তেজিত করে প্রথম অপুর্ন স্থরে নিতে বেশি শক্তিরও দরকার হয় না। উপধাতুর এই ধর্মই এদেরকে সবচেয়ে বেশি গুরত্বপুর্ণ ধাতুতে পরিণত করেছে। এই ধর্মের জন্যই সিলিকন সোলার সেল তৈরীতে ব্যাবহার হয়ে আসছে।

সোলার সেলের মূলনীতি বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে ইলেকট্রনে শক্তি শোষন আর নির্গমনের বিভিন্ন ধাপ সম্পর্কে। সবগুলো ধাপ একটি চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়, যাকে বলা হয় জাবলোন্সকি চিত্র (চিত্র)। এই চিত্রে কালো লাইন গুলো দিয়ে বুঝানো হচ্ছে শক্তিস্তর, সর্ববহিস্থ পুর্ণ স্তরকে S0, প্রথম অপুর্ণ স্তর S1 এবং দ্বিতীয় অপুর্ণ স্তরকে S2 দিয়ে বুঝানো হচ্ছে। এই চিত্রে উদাহরণ হিসাবে শুধু দুইটি স্তকে দেখানো হয়েছে, এই রকম উচ্চ শক্তির আরো অনেক স্তর থাকতে পারে। S0 স্তর থেকে কোন ইলেকট্রন শক্তি শোষন করে উচ্চ শক্তি স্তরে যায় (চিত্রে সবুজ তীর চিহ্নিত লাইন), কোন স্তরে যাবে সেটা নির্ভর করে শোষিত আলোর একটি ফোটনের শক্তির উপর। কারণ আমরা জানি আলোক শক্তি শক্তির একেকটা প্যাকেট আকারে থাকে, যাকে বলা হয় ফোটন। প্রতিটি শক্তিস্থরের কয়েকটি উপশক্তি স্থর থাকে, যেগুলোকে চিকন কালো দাগের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, ওগুলোকে বলা হয় ভাইব্রেশন স্থর। কারণ এগুলোর শক্তির পার্থক্য হচ্ছে কম্পনের মান ভিন্ন হওয়ার জন্য। উত্তেজিত ইলেকট্রন কম্পন শক্তি হিসাবে শক্তি নির্গমনের মাধ্যমে নিন্ম উপশক্তি স্তরে গমন করে। অন্যভাবে বললে এই কম্পন শক্তির পরিমান হচ্ছে বস্তুটির তাপ শক্তি। এই ধাপকে বলা হয় আন্তঃপরিবর্তন (internal conversion). এটিকে কাল ডটেট তীর দিয়ে বুঝানো হয়েছে। ইলেকট্রনটি যখন S1 এর সর্বনিন্ম উপশক্তি স্তরে আসবে, তখন কয়েকটি ভিন্ন প্রক্রিয়া সংঘটিত হতে পারে, যা নির্ভর করে বস্তুর রাসায়নিক, গাঠনিক এবং এর পারিপার্শিক ধর্মের উপর। এর মধ্যে একটি প্রক্রিয়া হচ্ছে উত্তেজিত ইলেকট্রনটি শক্তি নির্গত করে নিন্মশক্তিস্থরে (S0) গমন করে, সেই শক্তি কম্পন শক্তি হিসাবে (তাপ শক্তি হিসাবে, কোন বস্তুর কম্পনের পরিমান হচ্ছে সেই বস্তুর তাপশক্তি) অথবা আলোক শক্তি হিসাবে নির্গত হয়। তাপশক্তি হিসাবে নির্গত হলে তাকে বলা হয় অবিকিরন প্রক্রিয়া (নন-রেডিয়েটিভ পক্রিয়া, non-radiative process, চিত্রে কমলা রঙের ড্যাস লাইন) কারণ এই পক্রিয়ায় কোন আলো নির্গত হয় না, শুধু মাত্র তাপমাত্রা বেড়ে যায়। অন্যদিকে, ইলেক্ট্রনটি আলো নির্গত করেও নিম্ন শক্তিস্তরে যেতে পারে। আলোর ফোটনের শক্তি বা তার রঙ কি হবে সেটা নির্ভর করে S1 এবং S0 এর শক্তির পার্থ্যকের উপর (নীল তীর চিহ্নিত লাইন)। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ফ্লোরুসেন্স (fluorescence) । এই দুই পক্রিয়া বাদে অন্য একটি পক্রিয়ায়ও ইলেকট্রন নিম্ন শক্তিস্তরে যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে উত্তেজিত ইলেকট্রনের ঘুর্নন দিক পরিবর্তন হয় (যাকে স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা বলা হয়), তখন এটি আরেকটি শক্তিস্তরে গমন করে, যাকে বলা হয় ট্রিপলেট স্তর, কারণ এই শক্তিস্তরে সব গুলো ইলেকট্রনের স্পিন বা ঘুর্নন দিক একই রকম হয়। এই ধাপের নাম হচ্ছে আন্তঃসিস্টেম ক্রসিং (inter system crossing) ( চিত্রে - bold black arrow – বোল্ড তীর চিহ্নিত ) । এই  ট্রিপলেট স্তরের ( যাকে T1 হিসাবে দেখানো যায়) শক্তি সাধারনত প্রথম উচ্ছ শক্তিস্তর (S1) থেকে কম হয়। এর পর সেই শক্তি স্তুর থেকে আলোক শক্তি নির্গমনের মাধ্যমে ইলেকট্রনটি নিন্মশক্তিস্তরে যায়। আলোক শক্তি নির্গমনের এই পক্রিয়াকে বলা হয় ফসফোরোসেন্স (phosphorescence) (চিত্রে লাল তীর চিহ্নিত)। এই প্রক্রিয়ায় যেহেতু ইলেকট্রনের স্পিন বা ঘূর্ণন দিক পরিবর্তন হতে হয়,  তাই এটি শুধুমাত্র বিশেষ কিছু বস্তুতে হয়, এবং এই পক্রিয়ায় সময়ও বেশি লাগে। আমাদের ফোন বা টিভির স্ক্রিন অথবা এলইওডি বাল্ব এই দুই প্রক্রিয়ায় কাজ করে। 

আসুন এবার ইলেকট্রনের শক্তি শোষন আর নির্গমনের এই পুর্ন প্রক্রিয়াকে একটু অন্যভাবে দেখি। একটি ইলেকট্রন যখন উচ্চশক্তি স্তরে যায়, তার মানে হচ্ছে কিছু ঋনাত্বক আধান অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। তখন সেই ইলেকট্রনের জায়গায় কিছু ঋনাত্বক আধানের (negative charge) ঘাটতি হয়, অর্থাৎ আপাত ধনাত্বক আধান তৈরি হয়। এই আপাত ধনাত্বক আধানকে কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রির ভাষায় বলা হয় ‘হোল’ (hole), এর বিপরিত ঋনাত্বক আধানটি হচ্ছে ইলেকেট্রন। উত্তেজিত ইলেকট্রনটি যখন তাপ অথবা আলোক শক্তি নির্গমনের মাধ্যমে নিন্ম শক্তিস্তরে যায়, এটি হচ্ছে ঋনাত্বক আধান বিশিষ্ট ইলেকট্রন এবং ধনাত্বক আধান বিশিষ্ট ‘হোল’ এর মিলন, তাই সংক্ষেপে এই পক্রিয়াকে বলা হয় ইলেকট্রন-হোল পুনর্সমন্বয় (electron hole recombination). আমরা যদি এমন বস্তু তৈরী করতে পারি যেখানে ইলেকট্রন এবং হোলের আকর্ষন শক্তি খুবই কম (আমরা জানি ধনাত্বক আর ঋনাত্বক আধান একে অপরকে আকর্ষন করে, এই আকর্ষন বলকে সংক্ষেপে বলা হয় কুলম্ব বল, কারণ কুলম্বের সূত্র দিয়েই এই আকর্ষন বল হিসাব করা যায় ) , যার ফলে তারা পুনর্সমন্বয় করার আগেই তাদের আলাদা করে ফেলা যাবে। এই পক্রিয়া যদি অনবরত বজায় রাখা যায় তাহলে আমরা ধনাত্বক এবং ঋনাত্বক আধানের প্রবাহ পাব, অর্থাৎ ইলেকট্রনের প্রবাহ পাব অর্থাৎ ইলেকট্রিসিটি বা বিদ্যুৎ। এই প্রক্রিয়েকে বলা হয় ফটোভল্টাইক ইফেক্ট (photovoltaic effect)। এই বস্তু দিয়ে বিদ্যুৎ কোষ তৈরী করা হয়, যার নাম হচ্ছে সোলার সেল। 

  

তখন সেই ইলেকট্রন-নিউক্লিয়াস আকর্ষন শক্তি অনেক কম হয় তখন সেটি কে আলাদা করে ফেলা যায়, ধনাত্বক এবং ঋনাত্বক আধান আলাদা হয়ে যাওয়ার ফলে বিভব পার্থক্য তৈরী হবে। এই বিভব পার্থক্য বজায় রাখতে পারলে, নিরবিচ্চিন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহ পাওয়া যাবে। 

  

যদিও সৌরবিদ্যুত তৈরীর এই পক্রিয়া অনেক সহজ, কিন্তু পক্রিয়ার বজায় রাখা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। আমরা জানি ইলেকট্রনের প্রবাহ তখনই পাওয়া যাবে যখন দুইটি বিন্দুর মধ্যে বিভব পার্থক্য থাকে। সৌরকোষ তৈরীর সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে এই বিভব পার্থক্যকে একমুখী এবং নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বজায় রাখা।  উপধাতু থেকে ইলেকট্রন (ঋনাত্বক আধান) এবং হোল (ধনাত্বক আধান) সংগ্রহ করার জন্য দুই প্রান্তে দুইটি ধাতব সংগ্রাহক যুক্ত করা হয়। যার ফলে বিভব পার্থক্য আরো কমে যায় (২য় চিত্র)। ইলেক্ট্রনের ধর্ম হচ্ছে শক্তি শোষন করে উচ্চ শক্তিস্তরে যাওয়ার পর সেই শক্তিকে আলোক শক্তি অথবা তাপ শক্তি হিসাবে নির্গত করে আবার নিম্ন শক্তিস্তরে গমন করে। বেশি পরিমাণ ইলেকট্রনের প্রবাহ পাওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে উত্তেজিত ইলেকট্রন নিম্ন শক্তিস্তরে যাওয়ার আগে সেটিকে আলাদা করা। একটি সোলার সেলের কার্যক্ষমতা নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের উপর। এটি আবার নির্ভর করে ওই মৌল বা যৌগের কেলাসের গঠন, কেলাসের আকার, তাপমাত্রা ইত্যাদির উপর। প্রথম বানিজ্যিক ভাবে তৈরী সোলার সেল ছিল সিলিকনের এবং এর কার্যক্ষমতা ছিল ২-৪% এর মধ্যে। এত প্রযুক্তির উন্নয়নের পরও সর্বোচ্ছ কার্যক্ষমতার সিলিকন সোলার সেল তৈরী করেন অস্ট্রেলিয় বিজ্ঞানীরা, ২৫% কার্যক্ষমতার১। 

১। Link